উনিশশো আটানব্বই সালের ১৮ই ডিসেম্বরের এক ভোরবেলা। রাজধানী ঢাকার পুবাকাশে ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। মসজিদ থেকে মুসল্লিরা ফজরের নামাজ শেষে একে একে বেরিয়ে পড়ছেন পথে। এমন একটি সময়ে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে অবস্থিত ট্রাম্পস ক্লাবের নিচের দরোজার সামনে উপুড় হয়ে পড়েছিলো একটি দীর্ঘদেহী মানুষ। গুলিবিদ্ধ। চারপাশ তার রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো তখন।
রক্তেরস্রোতে নাইটক্লাবটির সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো নিচের দিকে। চারপাশে তখন শত শত মানুষের ভিড়। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা দেহটি আর কারো নয়, তখনকার একজন নামীদামি চিত্রনায়কের। তার নাম সোহেল চৌধুরী।
এফডিসির নতুন মুখের সন্ধানে নামের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন সোহেল চৌধুরী। একই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হন পারভিন সুলতানা দিতিও। পরে ভাগ্যবিধাতা এ দুই তারকাকে বসিয়ে দেন বিয়ের পিড়িতে। সেই সংসারে দুটি সন্তানও রয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, হত্যাকা-ের শিকার হয়ে পৃথিবী ছাড়েন এককালের হাটথ্রব নায়ক সোহেল চৌধুরী। আর চিত্রনায়কের মর্মান্তিক ওই হত্যাকা-টি ঘটেছিলো মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করতে যাওয়ার কারণেই।
অভিজাত বনানী এলাকার আবেদীন টাওয়ারের অষ্টম তলার ট্রাম্পস ক্লাবের তখন বেশ নামডাক। সেখানে রাতদিন চলতো মদ-পার্টিসহ নানা অসামাজিক কাজ। এর পাশেই ছিলো বনানী জামে মসজিদ। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর বাসাও ছিলো অদূরেই। এ কারণে মসজিদের পাশে এরকম অসামাজিকতা রুখতে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেন। মসজিদ কমিটিকে নিয়ে তিনি ক্লাবের অসামাজিক কাজ বন্ধে একাধিকবার চেষ্টাও চালান। কিন্তু তিনি এতে ব্যর্থ হন।
এ নিয়ে ক্লাবের মালিক বান্টি এবং আশীষের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর শত্রুতা তৈরি হয়। স্বার্থে আঘাত লাগে ক্লাবের নিয়মিত যাতায়াতকারী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়েরও। তাদের সবার চক্ষুশূলে পরিণত হন সোহেল চৌধুরী। ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই ট্রাম্প ক্লাবে উপস্থিত সবার সামনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর একদফা হাতাহাতিও হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ আজিজ ভাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বান্টি ও আশীষকে অনুরোধ জানান। পরে তারা তিন জনই সোহেল চৌধুরীকে হত্যার জন্য সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনকে প্রস্তাব দেন। ইমন পেশাদার কিলার। তাই ইমন প্রভাবশালী বান্টি-আশীষ গংগদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করেন।
এই ঘটনায় সোহেলের ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় মামলা করেন। ওই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামীদের মধ্যে ২৪ বছর পর ২০২২ সালে একমাত্র আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীকে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। যদিও পরে তিনি জামিনে বের হয়ে যান।
মামলার এজাহারে বলা হয়, সেই রাতে সোহেল তার বন্ধুদের নিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। রাত আড়াইটার দিকে আবারও তিনি ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সোহেলকে লক্ষ্য করে ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক ও আদনান গুলি চালান।
১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এরপর ২০০১ সালের ৩০ অক্টোবর ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০৩ সালে ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে পাঠানো হয়।
আসামিদের মধ্যে তারিক সাঈদ মামুনের পক্ষে ২০০৪ সালে হাই কোর্টে মামলাটি বাতিল চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত একটি রুল দেয়; সেই সঙ্গে বিচারিক আদালতে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ আসে। এরপর দীর্ঘদিন মামলাটির নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
২০১৫ সালের ৫ অগাস্ট হাই কোর্ট সেই রুল খারিজ করে রায় দিলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তারপর বিচারিক আদালতে পুনরায় বিচার শুরু হয়।
মামলাটিতে রাষ্ট্রপক্ষে মাত্র ১০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া গেছে। আসামিদের মধ্যে সানজিদুল হাসান ইমন এবং আশিষ রায় চৌধুরী গত ১১ ফেব্রুয়ারি আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে লিখিত বক্তব্য দেন। তারা দুজনেই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।
মামলার বর্তমান অবস্থা
সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে আসামিদের খালাসের দাবি জানান।
গত ১৯ মার্চ ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এ, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করেন। যুক্তি উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাদিয়া আফরিন শেলি সব আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রত্যাশা করেন। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ আসামিরা খালাস পাবেন বলে প্রত্যাশা করেন। এরপর আদালত অধিকতর যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ৩ এপ্রিল দিন ধার্য করেন।
চাঞ্চল্যকর এই মামলার আসামিরা হলেন: ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, সেলিম খান, দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, আদনান সিদ্দিকী ও ফারুক আব্বাসী।
/এম আই/