গণপূর্ত অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা নজরদারিতে
যারা দীর্ঘদিন ঢাকার বাইরে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ
অনিয়মে তদন্ত কমিটি গঠন হয়, বাস্তবায়ন হয় না
গণপূর্ত অধিদপ্তরে নতুন প্রধান প্রকৌশলী যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গে নতুন সিন্ডিকেটের উদয় হয়। প্রকৌশলী থেকে ঠিকাদার সবাই প্রতিষ্ঠান প্রধানের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টায় থাকেন। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার এর ব্যতিক্রম নয়। অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা সংস্থাপনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল আলম প্রধান প্রকৌশলীর আস্থাভাজন। তাই তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। আর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজ পাওয়ার আস্থাভাজন মাধ্যম হচ্ছে কিংডম বিল্ডার্স।
সিন্ডিকেট, অনিয়ম ও অস্থিরতার কারণে প্রতিষ্ঠানটির সাথে সরকারি অনেক দপ্তর কাজ বাস্তবায়নের চুক্তি থেকে সরে যাচ্ছে বলে জানা যায়। অতিমাত্রায় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শতাধিক কর্মকর্তা নজরদারিতে রয়েছেন বলে জানা যায়।
অস্থিরতার সূত্রপাত : গত ২৪ মার্চ একসাথে বেশ কয়েকজন উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী বদলির কারণে আবার আলোচনায় আসে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই আদেশের পর অনেকেই ক্ষুব্ধ হন, কারণ হিসেবে অনেকেই অভিযোগ করেন বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই আদেশটি করা হয়। বদলি আদেশে দেখা যায়, পদায়নকৃতদের ঢাকা থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে। ফলে যারা দীর্ঘদিন ঢাকার বাইরে তাদের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। রমজানের ঈদের আগে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট এই বদলি বাণিজ্য করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এই অনৈতিক বদলির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা। এছাড়াও ১৯ মার্চ উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনিরুজ্জামানকে নগর গণপূর্ত থেকে লক্ষীপুর গণপূর্তে বদলি নিয়েও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সাথে কর্তৃপক্ষের মতানৈক্যর সৃষ্টি হয়।
যদিও নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী স্বদেশ প্রতিদিনকে জানান, মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে। আর ডিপ্লোমা প্রকৌশলী নেতাদের দাবি, মনিরুজ্জামান তো একা দুর্নীতি করেন নাই, তাহলে ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে সবার বদলি করা হোক। আর এসব দাবি ও অনৈতিক বদলি বাণিজ্য নিয়ে অফিশিয়ালি কথা বলার জন্য বারবার চেষ্টা করে প্রধান প্রকৌশলীর সাক্ষাত না পেয়ে গত ১৫ মে তার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথার বলার চেষ্টা করলে বাংলাদেশ পিডব্লিউডি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সাধারণ সম্পাদককে গাড়িচাপা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী আন্দোলন বৃহৎ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে স্থগিত করে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি।
প্রধান প্রকৌশলীর তদন্ত হয়, বাস্তবায়ন হয় না : বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সাবেক প্রতিষ্ঠান এইচবিআরআইয়ে থাকাকালীন নানা অনিয়মের বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব ড. আশফাকুল ইসলাম বাবুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শেখ নূর মোহাম্মদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে তদন্ত কমিটিতে সদস্যসচিব করা হয়েছে যুগ্মসচিব (আইন শাখা-১) জহিরুল ইসলাম খান ও সদস্য যুগ্মসচিব মুহাম্মদ সোহেল হাসানকে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। অন্য এক চিঠিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বদলি বন্ধ করা হয়।
তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, মুরিদদের সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে শামীমের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত কমিটি। তারা অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ নিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর আর অনিয়মের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
অবমূল্যায়িত দুদকের সুপারিশ : গণপূর্ত অধিদপ্তরের দুর্নীতি নির্মূল করার লক্ষ্যে পাঁচ বছর আগে (২০১৯ সালে) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন সচিব মোহাম্মদ দেলোয়ার বখ্ত স্বাক্ষরিত এক পত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গঠিত দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষে গণপূর্ত অধিদপ্তর সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম-এর অনুসন্ধানকালে একটি সুপারিশমালা বাস্তবায়নে মন্ত্রীপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। যার স্মারক নং- দুদক/বি.অনু. ও তদন্ত-২/প্রাতি:/০১-২০১৭/অংশ-১৩। উক্ত সুপারিশমালায় দুর্নীতির কয়েকটি উৎসকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছর পরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
(‘ক’) দুর্নীতির উৎস
১/ টেন্ডার প্রক্তিয়ায় বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি (ক) যথাযথ প্রক্রিয়ায় টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করা, (খ) অপছন্দের ঠিকাদারকে নন রেসপন্সিভ করা, (গ) স্বাভাবিক মূল্যে প্রাক্কালন তৈরি, (ঘ) ছোট ছোট প্যাকেজে প্রকল্প প্রণয়ন, (ঙ) টেন্ডারের শর্তানুসারে কাজ বাস্তবায়ন না করা।
২/ নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার,
৩/ প্রকল্প প্রণয়ন, তদারকি, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কাজে ধীরগতি।
৪/ প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম।
৫/ অনাবশ্যক প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি।
৬/ স্থাপত্য ও কাঠামোগত নকশার চূড়ান্ত করণে বিলম্ব।
৭/ প্রত্যাশী সংস্থার প্রয়োজন মতো জরুরি ভিত্তিতে কার্যসম্পাদন না করা।
৮/ সেবা প্রদানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অসহযোগিতা।
৯/ সময় মতো ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ না করা।
১০/ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও ঠিকাদারদের আংশিক বিল পরিশোধ করা।
(‘খ’) দুর্নীতি প্রতিরোধে ২০টি সুপারিশমালা প্রেরণ করা হয়েছিল- যা আজও বাস্তবায়িত হয়নি।
দুদকের টিম পুনরায় গঠন : বহুল আলোচিত জিকে শামীম ইস্যুতে অনুসন্ধানটিম পুনর্গঠন করায় অনেকই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আশাবাদী। দুদকের মহাপরিচালক সৈয়দ ইকবালকে দলনেতা করে টিমটি পুনর্গঠন করা হয়। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেস্টা করে পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গণপূর্ত অধিদপ্তরে কোনো অস্থিরতা নেই, সব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলছে। যদি কোনো সিন্ডিকেট বা কেউ আমার নাম ভাঙিয়ে কিছু করার চেষ্টা করে আমাকে অবহিত করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউটে (এইচবিআরআই) থাকাকালীন অনিয়মের অভিযোগে তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টি তাকে অফিশিয়ালি জানানো হয়নি। তাই এ বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। দুর্নীতি বন্ধে দুদকের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়ে তিনি সংস্থাপনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহিদুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু শহিদুল আলমের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।