
বিশ্ব পর্যটন দিবস, বাংলাদেশে সহ সারা বিশ্বে ২৭ সেপ্টেম্বর World Tourism Day হিসেবে পালিত হবে। প্রতি বছর এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পর্যটনের গুরুত্ব এবং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মান তুলে ধরার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থা UNWTO ১৯৮০ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করছে।
এ বছর বিশ্ব পর্যটন দিবস এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে Tourism and Peace বা পর্যটন ও শান্তি তবে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এ দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে পর্যটন শান্তির সোপান নির্ধারন করেছে।
"পর্যটন শান্তির সোপান" বলতে বোঝানো হয় যে পর্যটন কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নয়, বরং এটি মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া, সহমর্মিতা এবং শান্তি বিকাশের মাধ্যম হিসেবেও কাজ করে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিশে নতুন জ্ঞান অর্জন করে, যা ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে সহায়ক। এর ফলে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
পর্যটনের মাধ্যমে মানুষ নতুন স্থান, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়। এটি তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়ার বিকাশ ঘটায়, যা শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪-এর প্রতিপাদ্যও এই ধারণাকে সমর্থন করে এবং পর্যটনকে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে তুলে ধরে।
প্রতি বছর বাংলাদেশে পর্যটন দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচি, সেমিনার, মেলা, এবং পর্যটন স্থানে বিশেষ উদ্যোগের মাধ্যমে পালন করা হয়, যা দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান পর্যটনের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেন, "বাংলাদেশে পর্যটন খাতের উন্নয়নের জন্য আমাদের আরও বেশি কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোর পরিকাঠামো, নিরাপত্তা ও সেবা মান উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি।"
তিনি আরও বলেন,"গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা , নোবেল লরিয়েট ড মোহাম্মদ ইউনুস এর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচারনা সম্ভব। এক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার এটাই মক্ষম সুযোগ। পাশাপাশি বৈদেশিক যোগাযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যটন শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং সেবার মান উন্নত করতে হবে।
বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ উপলক্ষে বাংলাদেশে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য "পর্যটন শান্তির সোপান", যা পর্যটনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তি এবং ঐক্য স্থাপনের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে।
নাসরীন জাহান বলেন, পর্যটন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে টেকসই পর্যটন ব্যবস্থাপনা জরুরি। এটি কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নয়, বরং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং স্থানীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণেও সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (BTB) বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২৪ উদযাপনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ২০২৪ সালের প্রতিপাদ্য "পর্যটন শান্তির সোপান" ভিত্তিক এই উদযাপনে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে তুলে ধরা এবং পর্যটনের মাধ্যমে শান্তি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করা হবে।
এ উপলক্ষে ঢাকায় একটি বর্ণাঢ্য রেলী আয়োজন করা হয়েছে, যা পার্যটন ভবন থেকে শুরু হবে। এতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, এয়ারলাইন, ট্রাভেল এজেন্সি এবং অন্যান্য পর্যটন শিল্পের কর্মীরা অংশ নেবেন। এই আয়োজনের পাশাপাশি একটি বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে , যেখানে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন সংস্থাগুলি অংশগ্রহণ করবে।
এ ছাড়া বিশ্ব পর্যটন দিবস দেশজুড়ে উদযাপিত হবে। দেশের প্রধান শহরগুলোতে বিশেষ র্যালি, পর্যটন মেলা, সেমিনার, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেটসহ বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে এই দিনটিকে ঘিরে বিশেষ কার্যক্রম চলবে। পর্যটন সংস্থাগুলি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে বিশেষ ছাড় এবং অফার দেওয়া হবে, যাতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকৃষ্ট করা যায়।
বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা ও সমস্যা
সম্ভাবনা:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: বাংলাদেশে রয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সাজেক ভ্যালি, রাঙ্গামাটি, সিলেটের চা-বাগান, এবং তাঙুয়ার হাওরের মতো আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক স্থান, যা স্থানীয় ও বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি: বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি পর্যটকদের জন্য একটি বড় আকর্ষণ। এখানে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান, যেমন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, ষাটগম্বুজ মসজিদ এবং সোনারগাঁওয়ের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা।
ধর্মীয় পর্যটন: বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনাও পর্যটন শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।
স্বল্প খরচ: বাংলাদেশে অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্যটন খরচ কম, যা বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সহায়ক।
সমস্যা:
অপর্যাপ্ত পরিকাঠামো: পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানে উন্নত নয়। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ইত্যাদির মান উন্নত করতে হবে।
পর্যাপ্ত প্রচার ও মার্কেটিংয়ের অভাব: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলির পর্যাপ্ত প্রচার নেই, ফলে অনেক বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশের পর্যটন সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন নয়, উন্নয়নের নামে ব্যাপক লুটপাট, দুর্নীতি আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অপার সম্ভাবনার এই খাতটি পিছিয়ে গেছে।
নিরাপত্তা সমস্যা: পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে কিছু অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা রয়েছে, যা পর্যটকদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, এ ক্ষেত্রে ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও ব্যাপক ভাবে কাজে লাগাতে হবে।
পরিবেশ দূষণ ও অবনতি: কিছু পর্যটন স্থানে পরিবেশ দূষণ এবং অযত্নের কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন উজাড়, প্লাস্টিক দূষণ, এবং অপরিকল্পিত নির্মাণ এ সমস্যাগুলো সৃষ্টি করছে।
মানসম্পন্ন সেবা ও প্রশিক্ষণের অভাব: পর্যটন শিল্পে কর্মরত ব্যক্তিদের মানসম্পন্ন সেবা এবং পেশাগত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে, যা পর্যটকদের অভিজ্ঞতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
সমাধান:
পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন করা।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পর্যটনের প্রচার বাড়ানো এবং দেশের পর্যটন নীতি শক্তিশালী করা।
পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং সেবার মান উন্নত করার জন্য পর্যাপ্ত আইন প্রণয়ন এবং প্রশিক্ষণ প্রদান।
পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং পরিবেশবান্ধব পর্যটন বিকাশ করা।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করতে নানা পদক্ষেপ নিতে পারে, এর মধ্যে কিছু প্রধান উদ্যোগ হলো:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা , নোবেল লরিয়েট ড মোহাম্মদ ইউনুস এর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রচারনা চালাতে হবে, এক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রচার ও বিপণন: বিদেশী পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলোর প্রচার ও বিজ্ঞাপন। বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, এছাড়া দেশীয় গনমাধ্যমেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রচার প্রয়োজন।
বিশেষ ইভেন্ট ও ফেস্টিভ্যাল: বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ ফেস্টিভ্যাল ও ইভেন্ট আয়োজন করা, বাংলাদেশের জাতীয় উৎসব গুলো আরও ব্যাপক প্রচারনায় আনা যাতে তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।
প্রযুক্তির ব্যবহার: পর্যটন সেবা ও তথ্য প্রদান করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: পর্যটন খাতে কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা এবং শিক্ষিত বেকারদের এ সেক্টরে আরও অংশ গ্রহনে আগ্রহী করা ।
সহযোগিতাঃ দেশি বিদেশী পর্যটন সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আরও যোগাযোগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, যাতে পর্যটন ব্যবসা সম্প্রসারণ করা যায়।
অর্থনৈতিক সুবিধা: বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশেষ ছাড় এবং প্যাকেজ প্রদান করা , যা তাদের বাংলাদেশ সফরকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে, এছাড়া প্রবাসীদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া।
নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাঃ বাংলাদেশের বিশাল একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেকারত্বের অভিশাপে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এছাড়া নতুন ব্যবসা কিংবা উদ্যোগ সৃষ্টিতে ব্যাপক বাধা। সকল বাধা দূর করে নতুন প্রজন্মকে পর্যটন সেবায় আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং এ খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে আগ্রহী করে তাদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা।
পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিদেশী পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ। নতুন ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ বিনির্মাণে নতুন প্রজন্মের অংশ গ্রহনের মাধ্যমে আমাদের পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাবে।
লেখক, খালেদ সাইফুল্লাহ মাহমুদ
পর্যটন উন্নয়ন কর্মী ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর