![](../2024/10/20/sw_1729411673.jpg)
* মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-সাংবাদিক হত্যা, আ.লীগ বিরোধী নেতা-সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা, ব্যবসায়িক নির্যাতন, পুলিশ সদস্যকে মারধরসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেরপুর থানায় যোগদেন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। বগুড়া জেলার ওই থানায় প্রায় ৮ মাস অফিসার ইনচার্জের (ওসি) দায়িত্ব পালন করেন। এ অল্প সময়ের মধ্যেই ওই উপজেলায় বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের সমর্থকদের তিনি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি, গ্রেপ্তার ও ঘরছাড়া করেন। থানাটিতে যোগ দিয়েই ওসি রফিকুল নাটক সাজিয়ে আগে গ্রেপ্তার করে ওই উপজেলা বিএনপি নেতা (বর্তমান সভাপতি) শহিদুল ইসলাম বাবলুকে। জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বাবলু স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৮ সালের দুই মাসের মাথায় পুলিশের সেই বিতর্কিত লোক শেরপুর থানার ওসি হিসেবে যোগদেন। ওই সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) গ্রেপ্তার হন। ম্যাডাম গ্রেপ্তারের ৬ দিন পরেই বোমা বানানোর নাটক সাজিয়ে আমাকে টাউনকলোনী থেকে গ্রেপ্তার করে ওসি রফিকুল।
আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন রফিকুল ইসলাম এভাবেই বিএনপি ও জামায়াত নিধনে মাঠে নেমেছিলেন। এ পুলিশ কর্মকর্তা বদলিও হতেন ইচ্ছেমতো এলাকায়। ওই দল দুটির প্রভাব-এমন থানায় তিনি বেছে নিতেন। গুলি করে মাদরাসার শিক্ষার্থী (হাফেজ) হত্যা, ছাদ থেকে ফেলে সাংবাদিক হত্যা, সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাসিয়ে দেওয়া, ব্যবসায়ীকে নির্যাতন-হত্যা, পুলিশ সদস্যকে মারধরসহ-এমন কোন অপরাধ নেই যে ওসি রফিক জড়িত নন। আওয়ামী লীগ নেতাদের শেল্টার দিয়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের ওপর হামলা এবং মামলা করানোই ছিল রফিকের নিত্যদিনের কর্মসূচি। মিথ্যা মালায় জড়িয়ে আলেম-ওলামা এবং সাধারণ মানুষদেরও তিনি চরম হয়রানি করতেন। পথ-ঘাটে সুযোগ বুঝে ওইসব ব্যক্তিদের থানায় এনে মাদক ও জঙ্গিসহ বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে নিতেন লাখ লাখ টাকা, জমি ও গহনাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র।
২০১৮ সালে পুলিশ সদর দপ্তরে একটি অভিযোগ দেন বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ এমপি হাবিবর রহমান। ওই অভিযোগে, ওসি রফিকুল ইসলামের নানা অপরাধের কথা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, রাস্তা থেকে নিরীহদের থানায় এনে মুক্তিপন স্বরুপ রফিক টাকা নেন, তার মতের বিরুদ্ধে গেলেই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। এবং জেলে দেন। দলটির সাবেক ওই এমপির পিএস কুরবান আলী মিলন জানিয়েছিলেন, ওসি রফিকুল ইসলাম নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে আসামি করে থানায় আটকে রাখেন। পরে, ২০-৩০ হাজার করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন। আর, দলীয় কোন নেতা বা কর্মী হলে লাখ-লাখ টাকাও নিতেন। তিনি বলেছিলেন, ওসি রফিক একজন জঘন্য খারাপ মানুষ। তার মুল উদ্দেশ্য ছিল বিএনপি-জামায়াত ধরনের লোকদের মামলা দিয়ে হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা। আর, এসবের মাধ্যমে বাণিজ্য করতেন লাখ-লাখ টাকা।
ওসি রফিকুল ইসলাম গুলশান থানায় বেশ দাপট দেখাতেন। গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর জেলায়। কিন্তু, গোপালগঞ্জের মানুষ ও ছাত্রলীগের সাবেক ক্ষমতাধর সভাপতি লিয়াকত সিকদারের ভাই বলে পরিচয় দিতেন । ১১ বছর আগে বালু বোঝাই ট্রাক রেখে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় আটকে দেওয়া ও তাকে হত্যাচেষ্টার রফিকুল ইসলাম মাস্টারমাইন্ড। খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করার অন্যতম তিনি একজন। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান ও দলটির নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। আর, এসব পরিচয়ে দাপট খাটাতেন পুলিশ প্রসাশনে। জনগণের সেবা দেওয়া নয়, ওসি হিসেবে তার প্রধান কাজ-ই ছিল আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন। ঘুষ বাণিজ্য করে হন অঢেল সম্পদের মালিক। তার রাজকীয় জীবনযাপনের কাছে দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের অনেকে হার মানে।
পুলিশের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের ঘটনার পর রফিকের কপাল খুলে যায়। পরপর দুদফা পদোন্নতি পান তিনি। ইন্সপেক্টর থেকে বনে যান অতিরিক্ত পুলিশ(এপিবিএন) সুপার। আওয়ামী লীগের পুরো সময়ে তিনি ছিলেন ক্ষমতাধর কর্মকর্তা। সূত্র জানান, শুলশান থানার তৎকালীন ওসি রফিকুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি চার দিনের রিমান্ডে আছেন। খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুভর্তি ট্রাক রেখে কাজে বাধা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গত ৪ অক্টোবর মামিলাটি করেন জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফুল ইসলাম শাওন। এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১১৩ জনকে আসামি করা হয়।
এর আগেও, চট্রগ্রামের হাটহাজারী থানায় একটি হত্যা মামলায় রফিকুল ইসলামকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। তিনি ওই থানার তৎকালীন ওসি ছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হন মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। মিছিলটির উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদ। ওই মিছিলে ওসি রফিকুল ইসলাম পুলিশকে গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এবং নিজেও শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন। গুলিতে নিহত হন মাদরাসা শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম (২৪)। সর্বশেষ রফিকুল ইসলাম এপিবিএন হেডকোয়াটারের সহকারি পুলিশ সুপার ছিলেন। গত ২২ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে তাকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়।
২০১৮ সালে বগুড়ায় এক সাংবাদিককে আক্রোশ থেকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছেন ওসি রফিকুল ইসলাম। বাদী পক্ষকে দিয়ে ওই সালের ২৮ জুলাই শেরপুর থানায় তিনি মামলাটি করিয়েছেন। ওই সাংবাদিক (ইসহাক) ঢাকায় কর্মরত। এবিষয়ে তিনি বলেন, আমার চাচাকে থানায় ধরে এনে বেধম মারপিট করেছিলেন ওসি রফিকুল। গ্রামের বাড়ি থেকে বিষয়টি জানতে পেরে তার মোবাইলে ব্যবহৃত (সরকারি) নম্বরটিতে আমার কথা হয়। এক পর্যায়ে রফিকুল আমাকে মামলায় আসামি করার হুমকি দেন। অনেক বাজে আচরণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর পুলিশ কর্মকর্তা বলে আমাকে ভয় দেখান-ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি বলেন, পরের দিন আশ্চার্য্য হয়ে দেখলাম ওই মামলায় আমাকে দুই নং আসামি করা হয়েছে। মামলাটির বাদী (কালু শেখ) যাকে করা হয়েছে, সে ব্যক্তিও আমাকে চিনেন না। তাকে দিয়ে আমাকে আসামী করা হয়েছে বলে, মামলাটির বাদি স্বীকার করেন। (দুই পক্ষের মধ্যে কলরেকডটি সংরক্ষীত আছে।)
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই সালে রফিকুল ইসলাম শেরপুর থানার ওসি ছিলেন। আর, বুলবুল আহমেদ ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে, বুলবুল আহমেদ ফেসবুকের ইনবক্সে চ্যাটিংয়ে ওই সাংবাদিককে মামলায় ফাসানোর কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, আমার করার কিছু ছিলো না। মামলার আসামিকে (ইসহাক) ঠিকভাবে চিনতাম না। আর, তিনি আমার সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করেননি। ওসি (রফিকুল) সাহেব কারো কথা শুনতো না। তার সিদ্ধান্ত ছিল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার। তবে, বুলবুল জানান, ওই সাংবাদিক নির্দোষ জেনেও আমাকে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়েছে। আর, শেরপুরের এক থেকে দুজন সাংবাদিক তাকে মামলায় জড়াতে ওসির সাথে যোগসাজস করেছেন।
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, রফিকুল ইসলাম ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে লালমনিরহাটে নিজ বাহিনীর সদস্যকেও মেরে গুরুতর আহত করেছিলেন। তিনি ওই সময় লালমনিরহাট সদর থানার ওসি ছিলেন। কনস্টেবল শামছুল হক (৪৫) নামের এ ব্যক্তিকে থানায় বেধম পিটিয়ে তার পরিবার নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছিলেন। লালমনিরহাটের বেশ কয়েজন জানিয়েছেন, ওসি রফিকুল ইসলাম বেশিদিন থানায় অবস্থান করেন না। যেখানে- যে থানায় গিয়েছেন অল্পদিন থেকেছেন। তারা জানান, পুলিশের এ লোকটির কাজই ছিল বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তাবায়ন। ব্যবহারের দিক থেকেও ছিলেন তিনি উগ্র মেজাজী। কথায়-কথায় আওয়ামী লীগের ঘরের লোক বলে অসভ্য আচরণ দেখাতো। এবং থানায় অন্য পুলিশ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথেও বিশ্রী ভাষা প্রয়োগ করতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, রাজধানীর যাত্রবাড়ী থানায়ও ওসি ছিলেন রফিকুল। ওই সময় যাত্রাবাড়ী এলাকার বিএনপি সমর্থিত এক ব্যবসায়ীকে অন্যায়ভাবে থানায় নিয়ে প্রহর করে। পরে, তাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কোর্টে প্রেরণ করেন। ওই ব্যবসায়ীর ছোট ভাই এ শোকে মৃত্যু বরণ করেছেন বলে সূত্র জানান। ২০১৪ সালে যাত্রাবাড়ী পশ্চিম থানায় ছাদ থেকে ফেলে এক সাংবাদিককে হত্যার অভিযোগ আছে কুখ্যাত খুনির রফিকের বিরুদ্ধে। তিনি ওই থানারও ওসি ছিলেন।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম। সংগঠনটির এক কর্মচারি জানান, ২০১৭ অথবা ১৮ সালের দিকে তিনি পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের দেখাতমে রফিকুল খুবই বাজে মানুষ। মাঝেমধ্যে আসতেন (সিভিল পোশাকে), আমাদের সাথে বাজে আচরণ করতেন। সংগঠনও আওয়ামী লীগ বানিয়ে ফেলেছিলো বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকার আই ব্লকের এক নম্বর রোডে প্লট নম্বর ৫৬৬/৫৬৭ সুরম্য ইমারতে রফিক বসবাস করেন ৫ম তলায়। ভবনটি আধুনিক স্থাপত্য নকশায় তৈরি সিঙ্গেল ইউনিটের। একেকটি সুপরিসর ফ্ল্যাটের আয়তন দুহাজার বর্গফুটের বেশি। তার দুই সন্তান দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। সেখানে তারা ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। এছাড়া রফিকের স্ত্রী আনজুমানারা বেগমও সন্তানদের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। রফিক নিজেও অস্ট্রেলিয়া যাতায়াতের ওপর থাকেন। প্রতি বছর একাধিকবার তিনি ছুটি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের আশীর্বাদে পুলিশ বাহিনীতে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন রফিক। ছাত্র-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত তার হাতে ছিল এলওসিসির চাবিকাঠি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রফিক নিজেই গর্ব করে বলেন, বিদেশে সন্তানদের কাউকে তিনি চাকরি করতে দেন না। তাদের লেখাপড়ার খরচ তিনি দেশ থেকেই পাঠান। অথচ সরকারি চাকরির বাইরে তার আর কোনো বৈধ উপার্জনের উৎস নেই। এ বিষয়ে বগুড়ার শেরপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শহিদুল ইসলাম বাবলু আরো বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের পুলিশ রফিকুলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। এ জঘন্য লোকটি আমাদের ম্যাডামকে হত্যাচেষ্টা করেছে। বেছে-বেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও জেলে দিয়েছে। রফিকের অবৈধ অর্থ-সম্পদের বাজেয়াপ্তের দাবিও তিনি করেন।
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর