*ঢাকায় মাদকের ভয়াবহ রুপ নিয়েছে
* ১ হাজার ১৮৫ শীর্ষ মাদক কারবারীর তালিকা প্রস্তুত
* জুলাই-নভেম্বরে ৩১ হাজার ৩৩৩টি অভিযান
মাদকে শুধু যুবকেরাই নয়। এর-আসক্তিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তবে, এরপরেও নানা রকম মাদক সেবন কারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একইসঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট (ছোট-বড়ো ও মাঝারি) কিছু রাজনীতিক ও প্রশাসনের সদস্যদের ম্যানেজ করে দেশের সর্বত্র মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে শাসনভার চলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে গেছেন। তথ্যমতে, তিনি এখনো ভারতের আশ্রয়ে আছেন।
গত ৫ আগস্টের পর পুলিশের অনেক সদস্যই কর্মস্থলে ফেরেনি। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বরখাস্ত ও চাকরিচুত করা হয়েছে। এছাড়া দেশে
ঢাকায় মাদকের ভয়াবহ রুপ নিয়েছে নানা ইস্যুর সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন দাবি-দফা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন আন্দোলনকারীরা। এসব পরিস্থিতির ফলে আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগ ও সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী। আর, এমন সুযোগ ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে 'মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট' ইচ্ছেমতো ঢুকাচ্ছে মাদকের বড়ো বড়ো চালান।
এদিকে, গত ৫ আগস্টের পর ঢাকায় মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কারবারীরা মাদকের চালান আনতে আগের চেয়ে আরো বেশি উঠেপুড়ে লেগেছে। তারা নগরীর পাড়া-মহল্লায় যুবক ও নানা বয়সী সেবনকারীদের মাদক বিক্রি বাড়িয়ে দিয়েছেন। তথ্যমতে, মাদক কারবারীদের সিন্ডিকেট রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় তাদের লোক দিয়ে নানা রকম মাদক-যেমন; গাঁজা, মদ (দেশি-বিদেশী), ফেন্সিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, টাপেন্ডাল, আইস সহ অন্য মাদক ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে। এরফলে ওইসকল মরণনেশা ভয়াবহ আকারে রূপ নিয়েছে। সেবনকারীদের মারছেও ভয়াল থাবা। আবার, আসক্ত হয়ে সেবনকারী মরনব্যাধী ক্যান্সার, কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া নষ্টসহ জটিল নানা রোগে জরাচ্ছেন। তবে, মৃত্যুর সংখ্যও আছে।
এদিকে, 'মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর' (ডিএনসি) মাদক নিয়ন্ত্রণে নতুন নতুন পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছে। এ লক্ষ্যই অধিদপ্তরটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও অন্যভাবে অভিযান পরিচালনা করছে। গত জুলাই থেকে নভেম্বর মাসে রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে, অভিযান, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, নানা রকম মাদক জব্দ, মামলা, আসামিদের গ্রেপ্তার, অর্থ দণ্ড দিয়েছে। একইসঙ্গে মাদক কারবারীদের কাছে থেকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করছে ডিএনসি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান (গত জুলাই-নভেম্বর) পেয়েছে
স্বদেশ প্রতিদিন। অধিদপ্তরটির অপারেশন শাখা থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানটিতে দেখা যায়, মোট ৩১ হাজার ৩৩৩টি অভিযান চালিয়েছে ডিএনসি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৭ হাজার ২১৮ টি, আগস্টে ৩ হাজার ৭৪৬টি, সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ১১১ টি ও অক্টোবরে ৭হাজার ৬২৭টি ও নভেম্বরে ৬ হাজার ৬৩১ টি। মোট মামলা: ২ হাজার ৪৯৪টি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৫৪২ টি, আগস্টে ১৭৫টি, সেপ্টেম্বরে ৫১২টি, অক্টোবরে ১হাজার ৬২টি ও নভেম্বরে ১ হাজার ৮৩টি। মোট মোবাইল কোর্ট পরিচালনা: ৪ হাজার ৩১৫টি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১ হাজার ৫৫ টি, আগস্টে ১২৭টি, সেপ্টেম্বরে ৭৮৮টি, অক্টোবরে ১হাজার ৬২টি ও নভেম্বরে ১ হাজার ৮৩টি। মোট আসামি: ৭ হাজার ৭৫ জন। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১ হাজার ৯০জন, আগস্টে ৩১৪জন, সেপ্টেম্বরে ১হাজার ৩৬ জন, অক্টোবরে ১হাজার ৮০ জন, ও নভেম্বরে ১ হাজার ৫৫ জন। মোট গাঁজা জব্দ: ২৯ লক্ষ্য ৮৪ হাজার ০৭১ কেজি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৬০৬.১৩৭ কেজি, আগস্টে ২০৯.৩৩ কেজি, সেপ্টেম্বরে ৮০১.৬ কেজি, অক্টোবরে ৫৮৮.১৭৪ কেজি, ও নভেম্বরে ৭৭৬.৮৩ কেজি। মোট ইয়াবা জব্দ: ৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৬০ পিস। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১৭৮৪৮১ পিছ, আগস্টে ৮৮৮৭৮ পিছ, ২৭৬৪৭৬, অক্টোবরে ১৯৪০২৫ পিছ। মোট ফেন্সিডিল (ডিল বোতল) জব্দ: ১০ হাজার ৬০৬ বোতল। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১ হাজার ৫১৫ বোতল, আগস্টে ৪৩১ বোতল, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৫১১ বোতল, অক্টোবরে ২ হাজার ৯০১ বোতল ও নভেম্বরে ৩ হাজার ২৪৮ বোতল। মোট টাপেন্টাডল উদ্ধার জব্দ: ৩৬ হাজার ৭১৫ পিস। এরমধ্যে জুলাইয়ে ২ হাজার ৭৯০ পিস, আগস্টে ১২ হাজার ৩৯ পিস, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৬৯৩ পিস, অক্টোবরে ৯ হাজার ১৫ পিস ও নভেম্বরে ১০ হাজার ১৭৮ পিস। মোট বিলাতি মদ জব্দ: ৩ হাজার ২৮২ বোতল। এরমধ্যে জুলাইয়ে ২৬৫ বোতল, আগস্টে ৩০ বোতল, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৪২৪ বোতল, অক্টোবরে ৪৩৬ বোতল ও নভেম্বরে ১২৭ বোতল। মোট চোলাই মদ জব্দ: ৮ হাজার ৯৫৩ লিটার। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১১০৯.৭২ লিটার, আগস্টে ৭৬.৭৫ লিটার, সেপ্টেম্বরে ১২২২.২ লিটার, অক্টেবরে ২০৬৪ লিটার ও নভেম্বরে ৪৪৮০ লিটার। মোট হেরোইন জব্দ: ৭ হাজার ২৯ গ্রাম। এরমধ্যে জুলাইয়ে ০.৬৯৯ গ্রাম, আগস্টে ২৩৯.৬২ গ্রাম, সেপ্টেম্বরে ৩৩০২ গ্রাম, অক্টোবরে ২১৩৫ গ্রাম ও নভেম্বরে ১৩৫১.৩ গ্রাম। মোট যানবাহন: জব্দ ১০৮ টি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ২৭ টি, আগস্টে ৪টি, সেপ্টেম্বরে ২৮টি, অক্টোবরে ২৬টি ও নভেম্বরে ২৩টি। মোট ইনজেকশন (এ্যাম্পুল) জব্দ: ১২ হাজার ৮৪১টি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৩ হাজার ১৩৪ টি, আগস্টে ৪৬৬ টি, সেপ্টেম্বরে ৩ হাজার ৭২২টি, অক্টোবরে ১ হাজার ৩৬২টি ও নভেম্বরে ৪ হাজার ১৫৭টি। মোট অস্ত্র জব্দ: ২৭ টি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১টি, আগস্টে ২টি, সেপ্টেম্বরে ১২টি, অক্টোবরে ৩টি ও নভেম্বরে ৯টি। মোট গুলি উদ্ধার: ৭৯ রাউন্ড। এরমধ্যে জুলাইয়ে ০ রাউন্ড, ৪ রাউন্ড, সেপ্টেম্বরে ৫১ রাউন্ড, অক্টোবরে ২৪ রাউন্ড ও নভেম্বরে ০ রাউন্ড। মোট নগদ টাকা জরিমানা আদায়: ১ কোটি ৮ হাজার ৩২৫ টাকা। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৪৪২৪৬০টাকা, আগস্টে ৩৯৬২০টাকা, সেপ্টেম্বরে ৪৬২২৫৫১টাকা, অক্টোবরে ১৬৫১৩৪৪ টাকা ও নভেম্বরে ৩২৫২৩৫০টাকা। মোট আইস জব্দ: ১ হাজার ১৪২ গ্রাম। এরমধ্যে জুলাইয়ে ০ গ্রাম, আগস্টে ০ গ্রাম, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১০ গ্রাম, অক্টোবরে ১০৩ গ্রাম ও নভেম্বরে ২৯ গ্রাম। মোট বিয়ার জব্দ: ২ হাজার ৮১৯ ক্যান। এরমধ্যে জুলাইয়ে ১৮০ ক্যান, আগস্টে ০ ক্যান, সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৪১৬ ক্যান, অক্টোবরে ০ ক্যান গ্রাম ও নভেম্বরে ২২৩ ক্যান। মোট আর/এস জব্দ: ৮ হাজার ৫৪.১৪ লিটার। এরমধ্যে জুলাইয়ে ৬ লিটার, আগস্টে ০ লিটার, সেপ্টেম্বরে ০ লিটার, অক্টোবরে ৮৪৮.১৪ লিটার ও নভেম্বরে ০ লিটার। মোট শিশা জব্দ: ৪২.৫৮২ কেজি। এরমধ্যে জুলাইয়ে ০ কেজি, আগস্টে ০ কেজি, সেপ্টেম্বরে ০ কেজি, অক্টোবরে ৪২.৫৮২ কেজি ও নভেম্বরে ০ কেজি। মোট ১৫ গ্রাম কুশ জব্দ: এরমধ্যে জুলাইয়ে ০ গ্রাম, আগস্টে ০ গ্রাম, সেপ্টেম্বরে ০ গ্রাম, অক্টোবরে ১৪.৯ গ্রাম ও নভেম্বরে ০ গ্রাম।
সূত্র জানায়, ঢাকায় বস্তিকেন্দ্রিক মাদক বিক্রেতার সংখ্যা বেশি। এরমধ্যে লালবাগ, তেজগাঁও, মালিবাগ, মোহাম্মদপুর, যাত্রবাড়ী, পুরান ঢাকা, ঢাকার অভিজাত এলাকায় মাদকের আস্তানা। এরমধ্যে ছোট-বড়ো একশোর বেশি মাদক কারবারী ও ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারও হয়েছে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান। তবে, এসবের পরেও মাদক কারবারী ও ব্যবসায়ী থামাছে না। তারা আইনের ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে ঠিকই বের হয়ে আসছে।
অপরদিকে, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন-ই বিভিন্ন জেলা হয়ে রাজধানীর বিভি- ন্ন প্রান্তে দেধারছে ঢুকছে মাদকের বড় বড় চালান। ডিএনসি জানায়, এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের নিয়মিত অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা রয়েছে। মাদক কারবারী ও ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের গ্রেপ্তার, সাজা, জরিমানা দেওয়া হচ্ছে। তবে, এতো কিছুর পরেও তারা কৌশল পরিবর্তন করে নিত্য- নতুনভাবে মাদক বেচাকেনায় জড়িয়ে পড়ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকায় যে-সকল মাদক বিক্রি হয়ে থাকে। তার বড়ো একটি অংশ-ই ভেজাল। সেবন করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে অহরহ। আবার, মাদকাক্তরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের একটি শিশু সংগঠনের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ শতাংশই কোনো-না; কোনোভাবে মাদক সেবন করে থাকে। ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও আট শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে। সংগঠনটির তথ্যানুযায়ী ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট আছে। সেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করছে। 'জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য-ইনস্টিটিউট' তথ্যমতে, ঢাকা বিভাগে প্রায় ৩০ শতাংশ ছেলে এবং ১৭ শতাংশ মেয়ে শিশু মাদকাসক্ত।
ঢাকায় মাদকের বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মায়ানমার থেকে আসছে। মাদক চোরাকারবারিরা সমুদ্র উপকূল ও জলপথকে তাদের পণ্য পাচারের খুবই উপযুক্ত পথ হিসেবে বিবেচনা করেন। ডিএনসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখেরও বেশি।
যেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ হচ্ছে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। ডিএনসি, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের তথ্যমতে, ঢাকার সংঘটিত বেশির ভাগ অপরাধের পেছনে আছে মাদক। মাদক সরবরাহে বাহক হিসেবে নারীদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
এবিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান (এনডিসি) স্বদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা ৫ আগস্টের পর থেকেই নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। অস্ত্র ও গুলি উদ্ধারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের মাদক জব্দ করেছি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে মাদক কারবারী ও ব্যবসায়ী এবং সেবনকারীদের জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে ১ হাজার ১৮৫ জন শীর্ষ মাদককারবরীর তালিকা করেছি। তাদের অনেককেই গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বিশেষ মাদক প্রবণ এলাকা হিসেবে দেশের কয়েকটি স্থানকে সনাক্ত করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন তাদের অস্ত্র দেওয়া হবে। এতে তাদের মধ্যমে অভিযান বেগবান হবে।
স্বদেশ প্রতিদিন/এমআর