#লাশ গ্রহণের জন্য, মা নিয়ে গিয়েছিলো অ্যাম্বুলেন্স
# হিন্দুধর্মাবলম্বী আকাশ মন্ডল , কেন মুসলিম নাম (ইরফান) ধারণ করে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলো ? অনুসন্ধান কি বলছে।
গত বছর ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরে ঈশানবালা খালের মুখ এলাকায় মেঘনা নদীতে থেমে থাকা জাহাজে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনা ঘটে। ঈশানবালা এলাকাটি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার পাশে। জাহাজটি নোঙর করা ছিল একটি নির্জন এলাকায়। চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় একমাত্র বেঁচে থাকা জুয়েল রানা, যার বয়স ৩৫ বছরের কাছাকাছি। রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধারের পর চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে, জুয়েল নৌ পুলিশের কাছে ঘটনা সম্পর্কিত কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শ্বাসনালি কাটা থাকায় কথা বলতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে তিনি কাগজে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেন। তবে একটি মুঠোফোন নম্বর এবং “আমি স..” লেখার পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে অ্যাম্বুলেন্সটি চাঁদপুর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের উদ্দেশ্য ছেড়ে আসে। রাত পৌনে ৯ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে জুয়েল রানা। পরবর্তীতে তাকে নাক, কান ও গলা বিভাগে ভর্তি করা হয়। শ্বাসনালি কেটে যাওয়ায় একটি টিউব যুক্ত করা হয়েছে তার গলায়। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর সে কথা বলার চেষ্টা করে। খুব আস্তে আস্তে এবং অস্পষ্ট হওয়ায় আমরা খাতায় লিখে দিতে বলি। তখন সে জানাচ্ছিল " সেদিন খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়ায় খুব বেশি ঘুম পাচ্ছিলো তার। ঘুমিয়ে যাওয়ার পর নিজেকে আবিষ্কার করে গলা কাটা অবস্থায়। জাহাজে মানুষজন দেখতে পাচ্ছিলো কিন্তু কোন কিছু প্রকাশ করতে পারছিলো না। মানুষজন যখন তাকে উদ্ধার করে চাঁদপুর হাসপাতালে নিয়ে যায় তখন সে লিখে ঘটনা সম্পর্কিত বলতে চাচ্ছিলো এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগের একটি নম্বর দিতে চাচ্ছিলো।"
টিভি সংবাদ, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়লে। ফেসবুকের মাধ্যমে জাহাজে সাত খুনের ঘটনা দেখে জুয়েলের মা। পরবর্তীতে লাশ গ্রহণের জন্য সাথে নিয়ে গিয়েছিলো অ্যাম্বুলেন্স।
ঘটনার ৪ দিন আগে অর্থাৎ গতবছরের ১৯ ডিসেম্বর আল-বাখেরা নামের জাহাজটিকে ইউরিয়া সার পরিবহনের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৮০০ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা জাহাজটির পণ্য পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স হামিদিয়া এন্টারপ্রাইজ। বরাদ্দের পর ২১ ডিসেম্বর জাহাজটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কাফকো জেটি থেকে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ৭২০ টন ইউরিয়া সার বোঝাই করে পরের দিন ভোরে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হয়। চট্টগ্রাম থেকে রওনা হওয়ার পর ২২ ডিসেম্বর রবিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে জাহাজটির মাস্টারের সঙ্গে জাহাজ মালিক দিপলু রানার সর্বশেষ কথা হয়। তখন মাস্টার জানিয়েছিলেন, মেঘনা নদীতে তাঁরা জাহাজের বহরের মধ্যেই আছেন। তবে জাহাজ মালিক দিপলু সকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে কেউ সাড়া দেননি। বারবার যোগাযোগ করে কাউকে না পেয়ে দিপলু , চাঁদপুরের হাইমচরের কাছাকাছি মুগনি-৩ নামের তাদের আরেকটি জাহাজের নাবিকদের বিষয়টি জানায়। মালিকের ফোন পেয়ে মুগনি-৩ জাহাজটি দুপুর একটার দিকে এমভি আল-বাখেরার কাছাকাছি যাওয়ার পর। মুগনি-৩ জাহাজ চালক বাচ্চু মিয়া আল–বাখেরা জাহাজে থাকা তাঁর ভাতিজা জুয়েলকে ফোন করেন। ফোনে সাড়া না পেয়ে পুনরায় ফোন করে মালিককে জানান তিনি। জাহাজ মালিক দিপলু তখন, বাচ্চুকে বলেন জাহাজটিতে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে জাহাজে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পাঁচজনকে পড়ে থাকতে দেখেন মুগলি-৩ জাহাজের সুকানি রবিউল। পাঁচজনের বাইরে আরও তিনজন গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে ছিলেন। এই ভয়ংকর পরিস্থিতি দেখে তাঁরা ৯৯৯–এ ফোন করেন। এরপর নৌ পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়।
ঘটনা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করে সেদিনই নৌ পুলিশ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন "আমরা দেখতে পায় জাহাজ কর্মীদের রক্তাক্ত দেহগুলো তাদের ঘুমানোর কক্ষে কক্ষে পড়ে ছিল। কারও কারও মাথায় গভীর ক্ষত দেখা গেছে। কারও কারও ছিল গলা কাটা। শরীরের অন্যান্য স্থানেও গভীর আঘাত ছিলো। ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে উদ্ধার করে চাঁদপুরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। একমাত্র বেঁচে থাকা জুয়েল নামের একজনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্ত করে বিষয়টি ডাকাতি মনে করছি না। এ ধরনের নৃশংসতম ঘটনা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে হচ্ছে। কারণ, সেখানে দুটি মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র অক্ষত পাওয়া যায়।’
জুয়েল রানার ভাই সেকেন খালাসী জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। জুয়েল চার বছর ধরে ওই জাহাজে সুকানির কাজ করছিলেন।
জাহাজের মাস্টার নিহত কিবরিয়ার ছোট ভাই আউয়াল হোসেন বলেন, গত ৩০ বছর ধরে আমার বড় ভাই এই পেশায় কাজ করে আসছেন। আমরা কখনো কারো সাথে তার দ্বন্দ্ব বা মনোমালিন্যের খবর পাইনি। তিনি সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। আমাদের জানামতে তার এত বড় শত্রু ছিল না যে তাকে হত্যা করতে পারে।
ইরফান নামে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর ঘটনার মোড় ঘুরে অন্য দিকে। নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নেয়ার কারণ রিমান্ডে নৌপুলিশকে জানিয়েছেন ২৬ বছর বয়স্ক ইরফান। তদন্তে তার এলাকার জীবনের পেছনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর জানান, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছেন তিনি ভৈরবে নৌযানে কর্মরত অবস্থায় কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতেই ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসি পদে চাকরি নেন। তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মণ্ডল নামটিই রয়েছে। র্যাব আটকের পর আকাশ মন্ডল র্যাবকে জানায় কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময় মতো পেতো না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করতো।
তিনি (আকাশ মণ্ডল) আরও বলেন যে, জাহাজের মাস্টার সকল কর্মচারীর উপর বিনা কারণে রাগারাগি করতো এবং কারোর উপর নাখোশ হলে তাকে কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতো, এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দিতো না। এ ব্যাপারে তিনি জাহাজের সবাইকে প্রতিবাদ করতে বললে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতো না বলে আকাশ মণ্ডল জানিয়েছেন। জাহাজের মাস্টারের কথিত এহেন কার্যকলাপের কারণেই আকাশ মণ্ডলের মাঝে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এই ক্ষোভ থেকে তাকে (মাস্টার) উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে সে।"
কুমিল্লার র্যাব ১১-এর উপ-পরিদর্শক মো. তারেক বলেন, ইরফানকে আমরা বাগেরহাটের চিলমারী থেকে গ্রেপ্তার করি। সেখানেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। একাই তিনি এই সাতটি খুন করেন। সবাইকে ঘুমের ওষুধ রাতের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ান। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজের মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নৃশংস পরিকল্পনা। পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে আরও ছয়জনকে তিনি হত্যা করেন। এ সময় জুয়েল নামে আরেকজনকে একই কায়দায় আঘাত করলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ঘটনার পর জুয়েলের মাধ্যমেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের রহস্য উন্মোচিত ও খুনি চিহ্নিত হয়েছে। যদিও কার্গো জাহাজ এমডি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ ডাবলু বলেন, ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিল। তাকে বেতন-ভাতাসহ অন্য সুবিধা দেয়া হতো না- এ অভিযোগ বানোয়াট। আমি সাত খুনের ঘটনায় ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে ইতোমধ্যে হাইমচর থানায় মামলা করেছি।
পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মণ্ডল নামেই পরিচিত। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই পুরো পরিবারের ছন্দপতন শুরু হয়। বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর তার মা ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে চলে যান। পরে সে নানা-নানির কাছে থাকেন। কিছু দিনের ব্যবধানে তার নানা-নানির মৃত্যু হয়। এরপর তার বড়ভাই বিধান মণ্ডলও একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে , আবির হোসেন নাম ধারণ করে। পরবর্তীতে সে ও তার বড় ভাই আলাদা থাকতে শুরু করেন।
ইরফানদের প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল বলেন, আকাশ মন্ডল নামের ছেলেটি ২০১৮ সালে একজন মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। ২০২২ সালে পুনরায় এলাকায় এসে বেশ কিছুদিন থাকে। কিছুদিন পর তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হন। পরবর্তীতে ফেসবুকে দেখে জানলাম তিনি জাহাজে সাত জনকে খুন করেছেন। তবে আকাশ মন্ডল অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেতের সবজি, গাছের ফল এবং পুকুরে মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিলেন। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখাননি।
আকাশ মণ্ডলের বড় ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকতেন সরকারি জায়গায় ঝুপড়ি ঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম। সেখানে কাজের সময় আকাশ প্রেমঘটিত একটি ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। পরবর্তীতে আমার দোকানটি বেশি দিন টিকেনি। গত বছর শীতে আকাশ একদিনের জন্য বাড়িতে আসলে পুনরায় তার সাথে আমার বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে। আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি এবং মাছ ধরা ও দিনমজুরি কাজ করত।
বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গলায় অসুস্থতায় কথা বলতে না পারলেও কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিলেন জুয়েল। সেখানে হতাহতের আটজন বাদে অন্য নামটি মূলত ইরফানই ছিল। তিনি জুয়েলের গলায় জখম চালিয়েছে। জুয়েলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতার করা হয়।