ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কারাগারগুলিতে থাকাকালীন নারী বন্দিরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন এবং কারাগারেই তাদের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে। গত বছর পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত ১৯৬ জন শিশু মায়ের সঙ্গে সংশোধনাগারে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্যগুলিতে কারাগারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিষয়টি নজরে আসে ‘অ্যামিকাস কিউরে’ বা আদালত বন্ধু হিসাবে নিযুক্ত আইনজীবী তাপস ভঞ্জ'র।
সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টকে এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছেন ওই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “রাজ্যের সংশোধনাগারগুলির (কারাগার) পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে যে ছবি উঠে এসেছে সেটা উদ্বেগজনক। সংশোধনাগারে থাকাকালীন নারী বন্দিরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন। ১৯৬ জন শিশু মায়ের সঙ্গে সংশোধনাগারে রয়েছে।”
কলকাতা হাইকোর্টে এই প্রতিবেদন পেশ করার পর দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি টি এস গণনম। বিষয়টি ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই এর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
তাপস ভঞ্জ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, জানুয়ারি মাসের ২২ তারিখ জেলা প্রশাসন এবং কারা বিভাগের আইজিসহ আমরা আলিপুর সংশোধনাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সে সময় এক নারী বন্দিকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দেখা যায়। এবং আলিপুর নারী কারাগারে ১৫জন শিশু তাদের মায়ের সঙ্গে রয়েছে, যাদের মধ্যে সাত জন স্কুলে পড়ে এবং আট জন কারাগারেই পড়াশোনা করে। একাধিক নারী কারাগারের মধ্যেই সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সেখানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভাল নয় এবং তা ক্রমশ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
নারী বন্দিদের পরিস্থিতির পাশাপাশি ওই প্রতিবেদনে অন্যান্য তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৪০০ জন নারী বন্দি ছিলেন, এই সংখ্যা কারাগারটির ধারণক্ষমতার অধিক হওয়ায়, সেখান থেকে ৯০ জনকে আলিপুর নারী সংশোধনাগারে স্থানান্তরিত করা হয়।
কেন কারাগারে অন্তঃসত্ত্বা বন্দি
কারাগারে বন্দিদের মধ্যে যারা এখন অন্তঃসত্ত্বা বা ইতিমধ্যেই সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তারা আগে থেকেই সন্তানসম্ভবা ছিলেন না কি জেলে এসে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তাপস ভঞ্জ বলেন, “এদের মধ্যে কেউ কেউ জেলের কর্মীদের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, এমনটা হতেই পারে। সেই কারণে আমি সুপারিশ করেছি, সংশোধনাগারে ঢোকার আগে প্রেগনেন্সি টেস্ট করা হোক। যাতে বোঝা যায়, কী কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।”
“দীর্ঘদিন জেল নিয়ে কাজ করার কারণে আমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। জেলে থাকা নারীরা আমাকে তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। একবার কারা বিভাগের কর্মীর স্ত্রী তার চিঠিতে এই ঘটনায় কর্মীদের যুক্ত থাকার কথাও জানিয়েছিলেন।
সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, আমার কাছে বিষয়টা নিজের শরীরের উপর বন্দিনী নারীর অধিকারের প্রশ্ন, সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন।
তার কথায়, এ ধরণের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যৌনতা কখনও কখনও একটা সুবিধা আদায়ের উপায়ও হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সেটাকে আমরা তার স্বাধীন পছন্দ ও সিদ্ধান্ত বলবো কি? বা যে সন্তানের জন্ম হলো, তার শৈশবের সুরক্ষার দায় নেবে কে?
কারাগারের ভেতরের চিত্র তুলে ধরে আইনজীবী তাপস ভঞ্জ বলেন, সংশোধনাগারের ভিতরে সব কিছু হয়। জেলের কর্মীদের সঙ্গে আবাসিকদের মারামারির ঘটনা দেখেছি আমি। সেখানে দু'টো পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষের হাতে অর্থ রয়েছে, তারা সংশোধনাগারে বসে সব রকম সুযোগ সুবিধা পায়। আরেক দল, যাদের অর্থ নেই। তারা নিজেদের অধিকারও বোঝে না। তারা ভাবে এটাই তাদের ভবিতব্য।
মায়ের সঙ্গে থাকা শিশুদের অবস্থা নিয়েও কথা বলেছেন তিনি।
বাচ্চারা ছয় বছর অব্দি মায়ের সঙ্গে সংশোধনাগারে থাকতে পারে। তারপর তাদের হোমে যাওয়ার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হদিশ মেলেনা।
সেই বাচ্চারা কোথায় যায়, কী হয়, তাদেরকে বিক্রি করে দেওয়া হয় কিনা, সেটাও আমরা এবার খতিয়ে দেখবো। এই পুরো বিষয়টার উপর নোট তৈরি করে আমি চিফ জাস্টিসকে দিয়েছি, বলেন তাপস ভঞ্জ।
কারাগারের বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে কলকাতা হাইকোর্টকে একাধিক সুপারিশ জানিয়েছেন তাপস ভঞ্জ।
সুপারিশ
এই সমস্যাগুলি থেকে রেহাই পেতে কয়েকটি সুপারিশ করেছেন মি. ভঞ্জ। কলকাতা হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, কারাগারে প্রবেশের আগে প্রেগনেন্সি টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হোক।
নারী বন্দিরা যেখানে থাকেন সেখানে কারা বিভাগের পুরুষ কর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হোক।
আইনজীবী তাপস ভঞ্জ বলেছেন, সংশোধনাগারে প্রবেশের সময় প্রেগনেন্সি টেস্ট করালে জানা যাবে, নারী বন্দিরা সন্তানসম্ভবা কি না। এতে তাদের স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া যাবে। অন্যদিকে, পুরুষ কারা কর্মীদের প্রবেশ নিষেধ হলে, যৌন নির্যাতনের বিষয়টিও এড়ানো যাবে।
এর পাশাপাশি সুপারিশ করা হয়েছে, মৃত বন্দিদের দেহের ময়না তদন্তের ভিডিও রেকর্ডিং বাধ্যতামূলক করা হোক। এছাড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির উপর জোর দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এই সুপারিশ নিয়ে কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন।
মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত শূর বলেন, সংশোধনাগারে নির্যাতনের ঘটনা এবং তারপর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
তবে একইসঙ্গে প্রত্যেক নারী আবাসিকদের সংশোধনাগারে আসার আগে বাধ্যতামূলকভাবে প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে বলাটা বাস্তবসম্মত নয়। এটা তাদের অধিকার লঙ্ঘন করার সামিল। আমরা পুরুষ কর্মীদের আসা বন্ধ করতে পারিনা।
একই কথা বলেছেন সমাজ কর্মী রত্নাবলী রায়। তার ভাষায়, উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা যদি শুধুই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করি, সেটাও তো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার দায়কে কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ আর ক্ষমতার শিকার নারীদের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এক্ষেত্রে তারা বরং সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলার উপর জোর দিচ্ছেন। স্বাস্থ্য ও পরিষেবার দিকে নজর দিতে হবে। নারীদের অধিকারের বিষয়ে জানাতে হবে। নিয়ম মেনে সন্তানসম্ভবা মায়েদের যে সুযোগ পাওয়ার কথা, সেটা দিতে হবে, বলেছেন মি. শূর।
/এমএ/